• বৃহঃস্পতিবার, ২০ নভেম্বর ২০২৫, ৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
  • ঢাকা, বাংলাদেশ

সাম্প্রতিক ঘটনা-প্রবাহ

সাম্প্রতিক ঘটনা-প্রবাহ

  আন্দোলন প্রতিবেদন  

বৃহঃস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৫  |  অনলাইন সংস্করণ

চট্টগ্রাম বন্দরের ৪টি টার্মিনাল বিদেশিদের হাতে তুলে দিচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার

চট্টগ্রাম বন্দরের পতেঙ্গা টার্মিনাল সৌদি আরবের রেড সী গেটওয়ে ইন্টারন্যাশনালের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। বর্তমানে চালু থাকা নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল সংযুক্ত আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ডকে, লালদিয়া কনটেইনার ডেনিশ শিপিং কোম্পানি মায়ের্সক লাইনের সহযোগী প্রতিষ্ঠান নেদারল্যান্ডভিত্তিক এপিএম টার্মিনালসকে, বেটার্মিনাল প্রকল্পের দুটি টার্মিনালের একটি সিঙ্গাপুরভিত্তিক পিএসএ ইন্টারন্যাশনাল এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ডের হাতে ছেড়ে দেওয়ার কাজ চলছে। সরকার ১৪ অক্টোবর’২৫ চট্টগ্রাম বন্দরের প্রায় ৪১% শতাংশ হারে নতুন বাড়তি মাশুল কার্যকর করেছে। বিদেশিদের হাতে ছেড়ে দেওয়া প্রকল্পের ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজার বিশ্বব্যাংক গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) গত এপ্রিলে তাদের প্রতিবেদনে বলেছে বিদ্যমান ট্যারিফ কাঠামো বেসরকারি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য যথেষ্ট নয়। এর পরই বন্দর মাশুল বাড়ানোর পদক্ষেপ নেয় সরকার।

১৫ অক্টোবর মাশুল বাড়ানোর প্রতিবাদে পরিবহণ মালিক সমিতি, শ্রমিক কর্মচারী সংগঠন এবং ব্যবসায়ী সমিতি মিলে বর্ধিত ফি প্রতা্যহারের দাবিতে কর্মসূচি ঘোষণা করে। তিনদিন অনেক ডিপো থেকে বন্দরে নিয়ে নির্ধারিত জাহাজে রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনার তুলে দেয়নি। ফলে বন্দরে গাড়ি প্রবেশের বর্ধিত ফি স্থগিত, শ্রমিক কর্মচারীদের মাশুল প্রত্যাহার এবং এক সপ্তাহের মধ্যে নতুন গেজেট প্রকাশ করার কথা জানায় বন্দর চেয়ারম্যান।

সরকারের গণবিরোধী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বন্ধ করতেই সরকার বন্দরে ১১ নভেম্বর’২৫ পর্যন্ত সভা-সমাবেশ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। ১১ নভেম্বরের মধ্যে বিদেশিদের সাথে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী চুক্তি করে ফেলার চেষ্টা করছে সরকার।

হাসিনা-আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকার যে সব গণবিরোধী চুক্তি বিদেশিদের সাথে শুরু করেছিল, অন্তর্বর্তী সরকার তার সবই বাস্তবায়ন করছে। এগুলো প্রমাণ করে যে, শত সহস্র জুলাই শহিদ ও আহতদের রক্তের সাথে কীভাবে বেইমানি করা হয়েছে সাম্রাজ্যবাদের অনুগত একটি সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়ে সর্বস্তরের জনগণকে অন্তর্বর্তী সরকারের জাতীয় স্বার্থ বিরোধী ও সাম্রাজ্যবাদের দালালি কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহবান জানানো হচ্ছে।

একের পর এক আগুন, মরছে শ্রমিক দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা?

১৪ অক্টোবর’২৫ মিরপুরের শিয়ালবাড়িতে একটি রাসায়নিক গুদাম এবং পোশাক কারখানায় আগুন লেগে ১৬ জন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। ১৫ অক্টোবর চট্টগ্রামের সিইপিজেড এলাকার অ্যাডামস ক্যাপস অ্যান্ড টেক্সটাইল লিমিটেড ও জিহং মেডিকেল কোম্পানির গুদামে আগুন লাগে। সাততলা ভবনের পুরোটিই আগুনে পুড়ে যায়। এবং পার্শ্ববর্তী ভবনেও আগুন ছড়িয়ে পড়ে। কোনো হতাহতের খবর জানা না গেলেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

১৭ অক্টোবর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের কার্গো ভিলেজে (আমদানি ও রপ্তানি পণ্য রাখার জায়গা) ভয়াবহ আগুনে পুড়ে গেছে কয়েক হাজার কোটি টাকার পণ্য সামাগ্রী।  মাত্র ৫ দিনের মধ্যে তিনটি জায়গার পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ব্যবসায়ী ও নাগরিকদের উদ্বেগ-প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে– এগুলো দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা।

রাষ্ট্রব্যবস্থার শাসকদের দায়িত্বহীনতা, অব্যবস্থাপনা প্রতিটি ঘটনার পর পরই ব্যাপক উঠে আসে। কিন্তু তার কোনো সুরাহাই হচ্ছে না। ক্ষমতায় যেতেও চলে নানা ষড়যন্ত্র। শুধুই পতিত ফ্যাসিবাদীদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে সরকার ও শাসকশ্রেণির বিভিন্ন অংশ পার পাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তারা ছাড়াও যে নব্য ফ্যাসিবাদী ও শাসকশ্রেণির বিভিন্ন সুযোগ-সন্ধানী শক্তিগুলো নিজ নিজ গোষ্ঠীস্বার্থে এগুলো করতে পারে তাকে চাপা দেয়া হয়। সর্বোপরি নিহত শ্রমিক, ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প-বাণিজ্যকে রক্ষার কোনো সু-ব্যবস্থাই এ রাষ্ট্রব্যবস্থা করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। আমরা প্রতিটি নিহত শ্রমিকের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ, চাকরিহারা শ্রমিক ও কর্মচারীদের চাকরি প্রদান ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার জোর দাবি তোলার আহ্বান জানাই।

এত এত সংস্কার, তবুও শিক্ষকরা রাজপথে, পুলিশ তাদের পেটায়

বিগত আওয়ামী সরকার ৩৬৪টি বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়কে সরকারিকরণ করেছিল। একই স্মারক ও তারিখে বিদ্যালয়গুলো সরকারিকরণ করা হয় এবং একই বিধিতে শিক্ষক-কর্মচারিদের নিয়োগ দেওয়া হলেও মাত্র ৪২টি মাধ্যামিক বিদ্যালয় এবং ৫টি স্কুল আ্যান্ড কলেজের শিক্ষক-কর্মচারিদের বেতন সুরক্ষা (পে-প্রটেকশন) প্রদান করে বেতন-ভাতা নির্ধারণ করা হয়। বাকি বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক-কর্মচারিদের পে-প্রটেকশন থেকে বঞ্চিত করা হয়। শিক্ষকরা বেসরকারিকালে তাদের বেতন-ভাতা নবম গ্রেডে উত্তোলন করতেন। কিন্তু সরকারিকরণে তাদের দশম গ্রেডে অবনমন করা হয়। ফলে তাদের বেসিক ছয় হাজার টাকা কামে যায়। একই সাথে পে-প্রটেকশন অপশন বন্ধ থাকায় তারা বেতন-ভাতা বাবদ প্রতিমাসে ৮-১০ হাজার টাকা কম পাচ্ছেন।  আবেদন করেও ব্যর্থ হয়ে সুবিধা বঞ্চিত শিক্ষকগণ ১২ অক্টোবর থেকে তিন দফার ভিত্তিতে (মূল বেতনের ২০% বাড়ি ভাড়া, ১,৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা এবং ৭৫% উৎসব ভাতা) আন্দোলনে নামেন।

প্রথমে সরকার আন্দোলনরত শিক্ষকদের উপর পুলিশী দমন-নিপীড়ন চালায়। শিক্ষকগণ রাজপথে আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। শেষ পর্যন্ত সরকার দুই ধাপে ১৫% বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির আশ্বাস দিলে শিক্ষকগণ আন্দোলন স্থগিত করে কাজে যোগ দেন। কিন্তু অন্য দুটি দাবি এখন পূরণ হয়নি বা পে-প্রটেকশন না থাকায় তাদের মূল সমস্যারও সমাধান হয়নি।

বুর্জোয়া সংবিধান নিয়ে সরকার ও বুর্জোয়া পার্টিগুলো ডজন ডজন বৈঠক করেছে, কিন্তু সংস্কারের গলাবাজিওয়ালা পার্টিগুলো ও সরকার কয়েক লক্ষ শিক্ষকদের ন্যায্য দাবিটাও মানছে না। এ কেমন “নতুন বন্দোবস্ত”র “নতুন” বাংলাদেশ?!

সারাদেশে ধর্মবাদীদের ফ্যাসিস্ট মব সন্ত্রাস

‎ছাত্র-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যুত্থানে হাসিনার-আওয়ামী ফ্যাসিবাদের পতনের পর উগ্র ইসলামপন্থি ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের উত্থান জাতীয় রাজনীতিতে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে, বিকশিত হচ্ছে। অব্যাহত ভাবে চলছে জামাতসহ ধর্মবাদীদের তথাকথিত “তৌহিদী জনতা”র নামে মব সন্ত্রাস। ‎আওয়ামী সরকারের আমলেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, কুমিল্লা, চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ, ভোলার বোরহানউদ্দিন সহ বিভিন্ন অঞ্চলে এই ধর্মীয় ফ্যাসিবাদীরা সংখ্যালঘু ধমর্ীয় সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতন, ভাঙ্গচুর, অগ্নিসংযোগ, দখল, লুটপাট, খুন-ধর্ষণসহ চরম সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়েছে।

৫ আগস্ট’২৪-এর পর যা হয়ে উঠেছে লাইসেন্স প্রাপ্ত এবং অপ্রতিরোধ্য। যা শুধু অন্য ধর্মের উপরই নয় নিজ ধর্মের সংখ্যালঘু বিশ্বাসীদের উপরও একই খড়গ দানব রূপে আবির্ভূত হয়েছে। ২১ ফেব্রুয়ারি’২৫ বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে “তৌহিদী ছাত্র-জনতা”র ব্যানারে এক বিক্ষোভ সমাবেশে হেফাজতে ইসলাম-এর শীর্ষস্থানীয় নেতা এনায়েতুল্লাহ আব্বাসী হেফাজতে ইসলাম কর্তৃক উত্থাপিত উগ্র ধর্মবাদী ১৩-দফা দাবি বাস্তবায়নের ঘোষণা দেয়। এর পরই শুরু হয়ে যায় ধর্মের নামে তান্ডবলীলা। তারা বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিনোদন, শিল্প-ব্যক্তিত্বদের, বিশেষ করে নারী শিল্পীদের অংশগ্রহণ, নারীদের পোশাক, চলাফেরা, খেলাধুলার উপর মধ্যযুগীয় আক্রমণ-সহিংসতা অবলীলায় চালিয়ে যাচ্ছে।

‎তৌহিদি জনতার নামে জামাত-হেফাজতে ইসলাম নিজ ধর্মের ভিন্ন মতাদর্শের বা চিন্তার সংখ্যালঘু মাজার ভক্ত, সুফিবাদী মুসলমানদের উপর অব্যাহত চালিয়ে যাচ্ছে ধর্মের নামে মব সন্ত্রাস। তারা সেপ্টেম্বর’২৪ এক মাসেই ধর্মের নামে ১২টি মব সন্ত্রাস চালিয়েছে। পূর্ব ঘোষণা দিয়েই মাজার ভেঙ্গেছে। তারপর ধারাবাহিক ভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে শত শত মাজার ভাঙ্গচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও বাৎসরিক মেলা বন্ধ করে ধর্ম রক্ষার নামে। অসংখ্য নিরীহ জনগণকে জখম-পঙ্গুত্বের শিকার এমনকি জীবনও হারাতে হচ্ছে। রাজবাড়ীতে নুরাল পাগলার লাশ কবর থেকে উঠিয়ে পুড়িয়ে দেয়ার বিভৎসতা ঘটানো হয়েছে।

‎ধর্মীয় ফ্যাসিস্টদের হাত থেকে লালন মেলা, শরৎ উৎসব, একুশে বইমেলাও রক্ষা পায়নি। রক্ষা পাচ্ছে না ভাস্কর্য শিল্প। বাউল-সুফিবাদী বৃদ্ধদের লম্বা চুল ও জট কেটে চরম অপমান, নিপীড়ন-নির্যাতন চলছে। রেহাই পাচ্ছেন না প্রগাতিশীল, কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীগণ। এখন ধর্মবাদীরা দাবি তুলছে স্কুলে গানের শিক্ষক বাদ দিয়ে ধর্ম শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। বাঙালি সংস্কৃতি বাতিল করার দাবি তুলছে।

‎ রাষ্ট্র-সরকার এদের আশ্রয়-প্রশ্রয় এমনকি মদদও দিচ্ছে। বিএনপি জোট, এনসিপি শ্রেণিগত আপস করে ধর্মবাদী হেফাজতের ভোট ব্যাংক দখলের চেষ্টা করছে। হেফাজতের কাঁধে বসে জামায়াত তার রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে।

নেপালেও গণঅভ্যুত্থান : কিন্তু ব্যবস্থা একই রয়ে গেছে

নেপালের শাসকশ্রেণির দুর্নীতি, বৈষম্য, স্বজনপ্রীতি এবং বেকারত্বের বিরুদ্ধে তরুণ প্রজন্ম ও সাধারণ জনগণ ছিল বিক্ষুব্ধ। এ সবের বিরুদ্ধে তরুণ ও নাগরিক সমাজ প্রতিবাদ আন্দোলনে নামলে তথাকথিত বাম অলি সরকার এই প্রতিবাদ নিয়ন্ত্রণ করতেই ৪ সেপ্টেম্বর’২৫  ফেসবুক, এক্স (সাবেক টুইটার) ও ইউটিউবসহ ২৬টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। সরকারের এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে কাঠমান্ডুসহ নেপালের প্রধান কয়েকটি শহরে তরুণ প্রজন্মের বিক্ষোভ শুরু হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করার এই ইস্যুটি উপলক্ষ্যে আন্দোলন তীব্র হলেও বিগত বছরগুলো থেকে সরকারের দুর্নীতি-লুটপাট, বৈষম্য– ইত্যাদির বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয় মূলত ৫ সেপ্টেম্বর থেকে। আন্দোলনে ৯ সেপ্টেম্বর প্রথমে ১৯ জন, শেষ পর্যন্ত ৭২ জন শহিদের রক্তে ভেজা রাজপথের আন্দোলনে নেপালের জনগণ কে. পি. শর্মা অলির নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন ঘটিয়েছেন। সরকারের মন্ত্রীরা হেলিকপ্টার দিয়ে রাজধানী থেকে পালিয়েছে।

কিন্তু বিপ্লবী রাজনীতি ও রাজনৈতিক পার্টির নেতৃত্ব না থাকায় অভ্যুত্থানকে দমন ও তার ফলকে হাইজ্যাক করেছে শাসকশ্রেণিরই অপর সব অংশ। তারা দ্রুত নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে। যার মাধ্যমে বুর্জোয়া শাসনকে বিপদমুক্ত করার আশা তারা করছে। কিন্তু এই নেপালেই দুই দশক আগে বিপ্লবী মাওবাদীরা প্রায় সমগ্র গ্রামাঞ্চল মুক্ত করে দেশের প্রধান রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছিল। যার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে প্রচণ্ড-বাবুরাম চক্র, এবং তারা ঘোট বাধে অলি শর্মাসহ সকল বাম নামের বুর্জোয়া পার্টি ও কংগ্রেসের ভারতীয় দালালদের সাথে। অভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতিকে নিজেদের করায়ত্বে নেয়ার জন্য খুবই সক্রিয় হয়ে উঠেছে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, চীনা সাম্রাজ্যবাদ ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা। এতে সহায়তা করছে বুর্জোয়া দলগুলো। ঠিক বাংলাদেশের মতোই। ব্যবস্থাকে উচ্ছেদকারী বিপ্লবী সংগ্রামের পথে নেপালি বিপ্লবীরা অগ্রসর হবেন, এটাই প্রত্যাশা।

পিআর নিয়ে জামাতের আন্দোলন

পিআর হলো নির্বাচনি ব্যবস্থার একটি রূপ। প্রচলিত প্রথায় জনগণ ভোট দিয়ে থাকেন ৩০০ আসনে নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে। এই ব্যক্তি সাধারণত কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি হিসেবে ভোটে দাঁড়ান। অথবা তিনি স্বতন্ত্রও হতে পারেন। পিআর-পদ্ধতিতে এরকম কোনো আসন ভাগ বা ব্যক্তিকে ভোট দেয়ার বিধান থাকে না। জনগণকে ভোট দিতে হবে নির্দিষ্ট পার্টিকে। সারা দেশে যে পার্টি যত ভোট পাবেন তার অনুপাতে তারা ৩০০ আসন থেকে এমপি বানাতে পারবেন। এক্ষেত্রে এই এমপি কারা হবেন তা সেই পার্টিগুলোর নেতারা ঠিক করবেন।

সম্প্রতি পিআর নিয়ে জামাত ও ধর্মবাদী দলগুলো আন্দোলনে নেমেছে। তাদের কারও কারও দাবি হলো পিআর ছাড়া নির্বাচন হবে না। অবশ্য ইতিমধ্যে এক নেতা বলেছেন যে, পিআর ছাড়া তারা নির্বাচনে যাবেন না সেটা নাকি তারা বলেননি।

এখানে অন্য বুর্জোয়া পার্টিগুলোর মূল আপত্তি হলো– পিআর পদ্ধতিটা দেশের জনগণ এখনো ভালোভাবে জানেন না ও বোঝেন না। অথচ এই দাবি নিয়ে কেন ধর্মবাদীরা মাঠ গরম করছে? তার মূল কারণ এটা যে, পিআর হলে জামাত-ধর্মবাদীরা বেশি আসন পাবে, প্রচলিত পদ্ধতিতে তা পাবে না। অন্যদিকে পিআর হলে বিএনপি মনে করছে তারা হয়তো এককভাবে সরকার গঠন করতে পারবে না। সবই নিজ নিজ দলীয় সুবিধার কথা।

তবে এটা সত্য যে, পিআর পদ্ধতিতে যেতে হলে নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে হবে না। কারণ, এটা হলেও কী পদ্ধতির পিআর সেটা ঠিক করতে বুর্জোয়া দলগুলোর আরো নয়মাস সময় লাগবে বিতর্ক করতে, যদিই বা তারা একমত হয়। পৃথিবীতে বহু পদ্ধতির পিআর রয়েছে। সবগুলোর ক্ষেত্রেই সুবিধা-অসুবিধা রয়েছে। তদুপরি, খোদ পিআর প্রশ্নেও সুবিধা-অসুবিধা রয়েছে। তাহলে কি ধরে নিতে হবে যে, জামাতসহ ধর্মবাদীরা এখন নির্বাচন ‘বানচাল’ করতে চায়, যা অনেকে বলছে? নাকি চাপ দিয়ে যতটা পারে সুবিধা আদায় করতে চায়?

জামাত আমির ক্ষমা চেয়েছেন

সম্প্রতি জামাত আমির আমেরিকার মাটিতে বসে জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। তিনি বলেছেন, ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত তাদের কোনো কার্যক্রমে যদি কারো ক্ষতি হয়ে থাকে তাহলে সেজন্য তারা ক্ষমাপ্রার্থী। সবাই জানেন যে, জামাত সম্পর্কে মূল অভিযোগটি হলো তারা ’৭১-সালে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার সহযোগী ছিল। জামাতের এ যুদ্ধাপরাধের কোনো প্রকৃত বিচার এ শাসকশ্রেণি ও রাষ্ট্রযন্ত্র করেনি। হাসিনা-আওয়ামী ফ্যাসিবাদীরা গণআন্দোলনের চাপে ও ভোটের মাঠের হিসেব কষে বিগত আমলে কিছু জামাত নেতাকে ’৭১-এর অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল। একইসাথে শেষ সময়ে জামাতকে নিষিদ্ধও করেছিল। এটা ছিল তার টিকে থাকার অপকৌশল। হাসিনার অপকৌশল যা-ই থাকুক না কেন, ’৭১-সালের ক্ষমা-অযোগ্য অপরাধের জন্য তাদের সার্বিক বিচার ও জামাত-রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি একটি গণতান্ত্রিক দাবি ছিল ও রয়েছে। কিন্তু হাসিনা-ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের ফাঁক গলে জামাত এখন জাতীয় রাজনীতিতে এতটা প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে যে, তারা এখন ক্ষমতায় যাবার স্বপ্নও দেখছে। এ সুযোগ তাদেরকে করে দিয়েছে বিগত কয়েক দশক ধরে হাসিনা-আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ প্রতিটি বুর্জোয়া পার্টি, বিশেষত বর্তমান ইউনূস সরকার। এ সরকার জামাতের বিরুদ্ধে সকল সঠিক মামলাগুলোও তুলে নিচ্ছে। জামাত এখন তাদের মৃতুদণ্ড প্রাপ্ত নেতাদেরকে শহিদ বলে দাবি করছে। এ অবস্থায় ‘যদি’ তারা ভুল করে থাকে বলার মাধ্যমে, এবং ’৪৭ থেকে এ পর্যন্ত দীর্ঘ ৭৭ বছর টেনে এনে ’৭১-কে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা নির্বাচনি অপকৌশল ও ফ্যাসিবাদী রাজনীতির ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়। কিছুদিন আগেও তাদের নেতারা বলেছে ’৭১-সালে বর্তমান নেতাদের জন্ম হয়নি বা তারা বালক ছিল; তাই তারা অপরাধী নয়। তাহলে কি ব্রিটিশ আমলের অপরাধের জন্য বর্তমান ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে আমরা দায়ী করবো না? বুর্জোয়া রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ জনমত তৈরি করছিল যে, তাদেরকে ক্ষমা চাইতে হবে। এখন যদি হাসিনা বা তার নেতারা বিগত হত্যাকাণ্ডের জন্য ক্ষমা চায় তাহলে কি তাদের রাজনীতি বৈধ হয়ে যাবে?

তাই, বুর্জোয়া রাজনীতির প্রতারণা ও সকল গোষ্ঠীর ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে উন্মোচন ও লড়াই অব্যাহত রাখতে হবে। 

–২৫-১০-’২৫

সাম্প্রতিক ঘটনা-প্রবাহ

 আন্দোলন প্রতিবেদন 
বৃহঃস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৫  |  অনলাইন সংস্করণ

চট্টগ্রাম বন্দরের ৪টি টার্মিনাল বিদেশিদের হাতে তুলে দিচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার

চট্টগ্রাম বন্দরের পতেঙ্গা টার্মিনাল সৌদি আরবের রেড সী গেটওয়ে ইন্টারন্যাশনালের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। বর্তমানে চালু থাকা নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল সংযুক্ত আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ডকে, লালদিয়া কনটেইনার ডেনিশ শিপিং কোম্পানি মায়ের্সক লাইনের সহযোগী প্রতিষ্ঠান নেদারল্যান্ডভিত্তিক এপিএম টার্মিনালসকে, বেটার্মিনাল প্রকল্পের দুটি টার্মিনালের একটি সিঙ্গাপুরভিত্তিক পিএসএ ইন্টারন্যাশনাল এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ডের হাতে ছেড়ে দেওয়ার কাজ চলছে। সরকার ১৪ অক্টোবর’২৫ চট্টগ্রাম বন্দরের প্রায় ৪১% শতাংশ হারে নতুন বাড়তি মাশুল কার্যকর করেছে। বিদেশিদের হাতে ছেড়ে দেওয়া প্রকল্পের ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজার বিশ্বব্যাংক গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) গত এপ্রিলে তাদের প্রতিবেদনে বলেছে বিদ্যমান ট্যারিফ কাঠামো বেসরকারি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য যথেষ্ট নয়। এর পরই বন্দর মাশুল বাড়ানোর পদক্ষেপ নেয় সরকার।

১৫ অক্টোবর মাশুল বাড়ানোর প্রতিবাদে পরিবহণ মালিক সমিতি, শ্রমিক কর্মচারী সংগঠন এবং ব্যবসায়ী সমিতি মিলে বর্ধিত ফি প্রতা্যহারের দাবিতে কর্মসূচি ঘোষণা করে। তিনদিন অনেক ডিপো থেকে বন্দরে নিয়ে নির্ধারিত জাহাজে রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনার তুলে দেয়নি। ফলে বন্দরে গাড়ি প্রবেশের বর্ধিত ফি স্থগিত, শ্রমিক কর্মচারীদের মাশুল প্রত্যাহার এবং এক সপ্তাহের মধ্যে নতুন গেজেট প্রকাশ করার কথা জানায় বন্দর চেয়ারম্যান।

সরকারের গণবিরোধী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বন্ধ করতেই সরকার বন্দরে ১১ নভেম্বর’২৫ পর্যন্ত সভা-সমাবেশ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। ১১ নভেম্বরের মধ্যে বিদেশিদের সাথে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী চুক্তি করে ফেলার চেষ্টা করছে সরকার।

হাসিনা-আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকার যে সব গণবিরোধী চুক্তি বিদেশিদের সাথে শুরু করেছিল, অন্তর্বর্তী সরকার তার সবই বাস্তবায়ন করছে। এগুলো প্রমাণ করে যে, শত সহস্র জুলাই শহিদ ও আহতদের রক্তের সাথে কীভাবে বেইমানি করা হয়েছে সাম্রাজ্যবাদের অনুগত একটি সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়ে সর্বস্তরের জনগণকে অন্তর্বর্তী সরকারের জাতীয় স্বার্থ বিরোধী ও সাম্রাজ্যবাদের দালালি কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহবান জানানো হচ্ছে।

একের পর এক আগুন, মরছে শ্রমিক দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা?

১৪ অক্টোবর’২৫ মিরপুরের শিয়ালবাড়িতে একটি রাসায়নিক গুদাম এবং পোশাক কারখানায় আগুন লেগে ১৬ জন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। ১৫ অক্টোবর চট্টগ্রামের সিইপিজেড এলাকার অ্যাডামস ক্যাপস অ্যান্ড টেক্সটাইল লিমিটেড ও জিহং মেডিকেল কোম্পানির গুদামে আগুন লাগে। সাততলা ভবনের পুরোটিই আগুনে পুড়ে যায়। এবং পার্শ্ববর্তী ভবনেও আগুন ছড়িয়ে পড়ে। কোনো হতাহতের খবর জানা না গেলেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

১৭ অক্টোবর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের কার্গো ভিলেজে (আমদানি ও রপ্তানি পণ্য রাখার জায়গা) ভয়াবহ আগুনে পুড়ে গেছে কয়েক হাজার কোটি টাকার পণ্য সামাগ্রী।  মাত্র ৫ দিনের মধ্যে তিনটি জায়গার পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ব্যবসায়ী ও নাগরিকদের উদ্বেগ-প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে– এগুলো দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা।

রাষ্ট্রব্যবস্থার শাসকদের দায়িত্বহীনতা, অব্যবস্থাপনা প্রতিটি ঘটনার পর পরই ব্যাপক উঠে আসে। কিন্তু তার কোনো সুরাহাই হচ্ছে না। ক্ষমতায় যেতেও চলে নানা ষড়যন্ত্র। শুধুই পতিত ফ্যাসিবাদীদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে সরকার ও শাসকশ্রেণির বিভিন্ন অংশ পার পাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তারা ছাড়াও যে নব্য ফ্যাসিবাদী ও শাসকশ্রেণির বিভিন্ন সুযোগ-সন্ধানী শক্তিগুলো নিজ নিজ গোষ্ঠীস্বার্থে এগুলো করতে পারে তাকে চাপা দেয়া হয়। সর্বোপরি নিহত শ্রমিক, ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প-বাণিজ্যকে রক্ষার কোনো সু-ব্যবস্থাই এ রাষ্ট্রব্যবস্থা করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। আমরা প্রতিটি নিহত শ্রমিকের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ, চাকরিহারা শ্রমিক ও কর্মচারীদের চাকরি প্রদান ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার জোর দাবি তোলার আহ্বান জানাই।

এত এত সংস্কার, তবুও শিক্ষকরা রাজপথে, পুলিশ তাদের পেটায়

বিগত আওয়ামী সরকার ৩৬৪টি বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়কে সরকারিকরণ করেছিল। একই স্মারক ও তারিখে বিদ্যালয়গুলো সরকারিকরণ করা হয় এবং একই বিধিতে শিক্ষক-কর্মচারিদের নিয়োগ দেওয়া হলেও মাত্র ৪২টি মাধ্যামিক বিদ্যালয় এবং ৫টি স্কুল আ্যান্ড কলেজের শিক্ষক-কর্মচারিদের বেতন সুরক্ষা (পে-প্রটেকশন) প্রদান করে বেতন-ভাতা নির্ধারণ করা হয়। বাকি বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক-কর্মচারিদের পে-প্রটেকশন থেকে বঞ্চিত করা হয়। শিক্ষকরা বেসরকারিকালে তাদের বেতন-ভাতা নবম গ্রেডে উত্তোলন করতেন। কিন্তু সরকারিকরণে তাদের দশম গ্রেডে অবনমন করা হয়। ফলে তাদের বেসিক ছয় হাজার টাকা কামে যায়। একই সাথে পে-প্রটেকশন অপশন বন্ধ থাকায় তারা বেতন-ভাতা বাবদ প্রতিমাসে ৮-১০ হাজার টাকা কম পাচ্ছেন।  আবেদন করেও ব্যর্থ হয়ে সুবিধা বঞ্চিত শিক্ষকগণ ১২ অক্টোবর থেকে তিন দফার ভিত্তিতে (মূল বেতনের ২০% বাড়ি ভাড়া, ১,৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা এবং ৭৫% উৎসব ভাতা) আন্দোলনে নামেন।

প্রথমে সরকার আন্দোলনরত শিক্ষকদের উপর পুলিশী দমন-নিপীড়ন চালায়। শিক্ষকগণ রাজপথে আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। শেষ পর্যন্ত সরকার দুই ধাপে ১৫% বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির আশ্বাস দিলে শিক্ষকগণ আন্দোলন স্থগিত করে কাজে যোগ দেন। কিন্তু অন্য দুটি দাবি এখন পূরণ হয়নি বা পে-প্রটেকশন না থাকায় তাদের মূল সমস্যারও সমাধান হয়নি।

বুর্জোয়া সংবিধান নিয়ে সরকার ও বুর্জোয়া পার্টিগুলো ডজন ডজন বৈঠক করেছে, কিন্তু সংস্কারের গলাবাজিওয়ালা পার্টিগুলো ও সরকার কয়েক লক্ষ শিক্ষকদের ন্যায্য দাবিটাও মানছে না। এ কেমন “নতুন বন্দোবস্ত”র “নতুন” বাংলাদেশ?!

সারাদেশে ধর্মবাদীদের ফ্যাসিস্ট মব সন্ত্রাস

‎ছাত্র-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যুত্থানে হাসিনার-আওয়ামী ফ্যাসিবাদের পতনের পর উগ্র ইসলামপন্থি ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের উত্থান জাতীয় রাজনীতিতে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে, বিকশিত হচ্ছে। অব্যাহত ভাবে চলছে জামাতসহ ধর্মবাদীদের তথাকথিত “তৌহিদী জনতা”র নামে মব সন্ত্রাস। ‎আওয়ামী সরকারের আমলেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, কুমিল্লা, চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ, ভোলার বোরহানউদ্দিন সহ বিভিন্ন অঞ্চলে এই ধর্মীয় ফ্যাসিবাদীরা সংখ্যালঘু ধমর্ীয় সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতন, ভাঙ্গচুর, অগ্নিসংযোগ, দখল, লুটপাট, খুন-ধর্ষণসহ চরম সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়েছে।

৫ আগস্ট’২৪-এর পর যা হয়ে উঠেছে লাইসেন্স প্রাপ্ত এবং অপ্রতিরোধ্য। যা শুধু অন্য ধর্মের উপরই নয় নিজ ধর্মের সংখ্যালঘু বিশ্বাসীদের উপরও একই খড়গ দানব রূপে আবির্ভূত হয়েছে। ২১ ফেব্রুয়ারি’২৫ বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে “তৌহিদী ছাত্র-জনতা”র ব্যানারে এক বিক্ষোভ সমাবেশে হেফাজতে ইসলাম-এর শীর্ষস্থানীয় নেতা এনায়েতুল্লাহ আব্বাসী হেফাজতে ইসলাম কর্তৃক উত্থাপিত উগ্র ধর্মবাদী ১৩-দফা দাবি বাস্তবায়নের ঘোষণা দেয়। এর পরই শুরু হয়ে যায় ধর্মের নামে তান্ডবলীলা। তারা বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিনোদন, শিল্প-ব্যক্তিত্বদের, বিশেষ করে নারী শিল্পীদের অংশগ্রহণ, নারীদের পোশাক, চলাফেরা, খেলাধুলার উপর মধ্যযুগীয় আক্রমণ-সহিংসতা অবলীলায় চালিয়ে যাচ্ছে।

‎তৌহিদি জনতার নামে জামাত-হেফাজতে ইসলাম নিজ ধর্মের ভিন্ন মতাদর্শের বা চিন্তার সংখ্যালঘু মাজার ভক্ত, সুফিবাদী মুসলমানদের উপর অব্যাহত চালিয়ে যাচ্ছে ধর্মের নামে মব সন্ত্রাস। তারা সেপ্টেম্বর’২৪ এক মাসেই ধর্মের নামে ১২টি মব সন্ত্রাস চালিয়েছে। পূর্ব ঘোষণা দিয়েই মাজার ভেঙ্গেছে। তারপর ধারাবাহিক ভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে শত শত মাজার ভাঙ্গচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও বাৎসরিক মেলা বন্ধ করে ধর্ম রক্ষার নামে। অসংখ্য নিরীহ জনগণকে জখম-পঙ্গুত্বের শিকার এমনকি জীবনও হারাতে হচ্ছে। রাজবাড়ীতে নুরাল পাগলার লাশ কবর থেকে উঠিয়ে পুড়িয়ে দেয়ার বিভৎসতা ঘটানো হয়েছে।

‎ধর্মীয় ফ্যাসিস্টদের হাত থেকে লালন মেলা, শরৎ উৎসব, একুশে বইমেলাও রক্ষা পায়নি। রক্ষা পাচ্ছে না ভাস্কর্য শিল্প। বাউল-সুফিবাদী বৃদ্ধদের লম্বা চুল ও জট কেটে চরম অপমান, নিপীড়ন-নির্যাতন চলছে। রেহাই পাচ্ছেন না প্রগাতিশীল, কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীগণ। এখন ধর্মবাদীরা দাবি তুলছে স্কুলে গানের শিক্ষক বাদ দিয়ে ধর্ম শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। বাঙালি সংস্কৃতি বাতিল করার দাবি তুলছে।

‎ রাষ্ট্র-সরকার এদের আশ্রয়-প্রশ্রয় এমনকি মদদও দিচ্ছে। বিএনপি জোট, এনসিপি শ্রেণিগত আপস করে ধর্মবাদী হেফাজতের ভোট ব্যাংক দখলের চেষ্টা করছে। হেফাজতের কাঁধে বসে জামায়াত তার রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে।

নেপালেও গণঅভ্যুত্থান : কিন্তু ব্যবস্থা একই রয়ে গেছে

নেপালের শাসকশ্রেণির দুর্নীতি, বৈষম্য, স্বজনপ্রীতি এবং বেকারত্বের বিরুদ্ধে তরুণ প্রজন্ম ও সাধারণ জনগণ ছিল বিক্ষুব্ধ। এ সবের বিরুদ্ধে তরুণ ও নাগরিক সমাজ প্রতিবাদ আন্দোলনে নামলে তথাকথিত বাম অলি সরকার এই প্রতিবাদ নিয়ন্ত্রণ করতেই ৪ সেপ্টেম্বর’২৫  ফেসবুক, এক্স (সাবেক টুইটার) ও ইউটিউবসহ ২৬টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। সরকারের এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে কাঠমান্ডুসহ নেপালের প্রধান কয়েকটি শহরে তরুণ প্রজন্মের বিক্ষোভ শুরু হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করার এই ইস্যুটি উপলক্ষ্যে আন্দোলন তীব্র হলেও বিগত বছরগুলো থেকে সরকারের দুর্নীতি-লুটপাট, বৈষম্য– ইত্যাদির বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয় মূলত ৫ সেপ্টেম্বর থেকে। আন্দোলনে ৯ সেপ্টেম্বর প্রথমে ১৯ জন, শেষ পর্যন্ত ৭২ জন শহিদের রক্তে ভেজা রাজপথের আন্দোলনে নেপালের জনগণ কে. পি. শর্মা অলির নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন ঘটিয়েছেন। সরকারের মন্ত্রীরা হেলিকপ্টার দিয়ে রাজধানী থেকে পালিয়েছে।

কিন্তু বিপ্লবী রাজনীতি ও রাজনৈতিক পার্টির নেতৃত্ব না থাকায় অভ্যুত্থানকে দমন ও তার ফলকে হাইজ্যাক করেছে শাসকশ্রেণিরই অপর সব অংশ। তারা দ্রুত নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে। যার মাধ্যমে বুর্জোয়া শাসনকে বিপদমুক্ত করার আশা তারা করছে। কিন্তু এই নেপালেই দুই দশক আগে বিপ্লবী মাওবাদীরা প্রায় সমগ্র গ্রামাঞ্চল মুক্ত করে দেশের প্রধান রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছিল। যার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে প্রচণ্ড-বাবুরাম চক্র, এবং তারা ঘোট বাধে অলি শর্মাসহ সকল বাম নামের বুর্জোয়া পার্টি ও কংগ্রেসের ভারতীয় দালালদের সাথে। অভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতিকে নিজেদের করায়ত্বে নেয়ার জন্য খুবই সক্রিয় হয়ে উঠেছে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, চীনা সাম্রাজ্যবাদ ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা। এতে সহায়তা করছে বুর্জোয়া দলগুলো। ঠিক বাংলাদেশের মতোই। ব্যবস্থাকে উচ্ছেদকারী বিপ্লবী সংগ্রামের পথে নেপালি বিপ্লবীরা অগ্রসর হবেন, এটাই প্রত্যাশা।

পিআর নিয়ে জামাতের আন্দোলন

পিআর হলো নির্বাচনি ব্যবস্থার একটি রূপ। প্রচলিত প্রথায় জনগণ ভোট দিয়ে থাকেন ৩০০ আসনে নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে। এই ব্যক্তি সাধারণত কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি হিসেবে ভোটে দাঁড়ান। অথবা তিনি স্বতন্ত্রও হতে পারেন। পিআর-পদ্ধতিতে এরকম কোনো আসন ভাগ বা ব্যক্তিকে ভোট দেয়ার বিধান থাকে না। জনগণকে ভোট দিতে হবে নির্দিষ্ট পার্টিকে। সারা দেশে যে পার্টি যত ভোট পাবেন তার অনুপাতে তারা ৩০০ আসন থেকে এমপি বানাতে পারবেন। এক্ষেত্রে এই এমপি কারা হবেন তা সেই পার্টিগুলোর নেতারা ঠিক করবেন।

সম্প্রতি পিআর নিয়ে জামাত ও ধর্মবাদী দলগুলো আন্দোলনে নেমেছে। তাদের কারও কারও দাবি হলো পিআর ছাড়া নির্বাচন হবে না। অবশ্য ইতিমধ্যে এক নেতা বলেছেন যে, পিআর ছাড়া তারা নির্বাচনে যাবেন না সেটা নাকি তারা বলেননি।

এখানে অন্য বুর্জোয়া পার্টিগুলোর মূল আপত্তি হলো– পিআর পদ্ধতিটা দেশের জনগণ এখনো ভালোভাবে জানেন না ও বোঝেন না। অথচ এই দাবি নিয়ে কেন ধর্মবাদীরা মাঠ গরম করছে? তার মূল কারণ এটা যে, পিআর হলে জামাত-ধর্মবাদীরা বেশি আসন পাবে, প্রচলিত পদ্ধতিতে তা পাবে না। অন্যদিকে পিআর হলে বিএনপি মনে করছে তারা হয়তো এককভাবে সরকার গঠন করতে পারবে না। সবই নিজ নিজ দলীয় সুবিধার কথা।

তবে এটা সত্য যে, পিআর পদ্ধতিতে যেতে হলে নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে হবে না। কারণ, এটা হলেও কী পদ্ধতির পিআর সেটা ঠিক করতে বুর্জোয়া দলগুলোর আরো নয়মাস সময় লাগবে বিতর্ক করতে, যদিই বা তারা একমত হয়। পৃথিবীতে বহু পদ্ধতির পিআর রয়েছে। সবগুলোর ক্ষেত্রেই সুবিধা-অসুবিধা রয়েছে। তদুপরি, খোদ পিআর প্রশ্নেও সুবিধা-অসুবিধা রয়েছে। তাহলে কি ধরে নিতে হবে যে, জামাতসহ ধর্মবাদীরা এখন নির্বাচন ‘বানচাল’ করতে চায়, যা অনেকে বলছে? নাকি চাপ দিয়ে যতটা পারে সুবিধা আদায় করতে চায়?

জামাত আমির ক্ষমা চেয়েছেন

সম্প্রতি জামাত আমির আমেরিকার মাটিতে বসে জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। তিনি বলেছেন, ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত তাদের কোনো কার্যক্রমে যদি কারো ক্ষতি হয়ে থাকে তাহলে সেজন্য তারা ক্ষমাপ্রার্থী। সবাই জানেন যে, জামাত সম্পর্কে মূল অভিযোগটি হলো তারা ’৭১-সালে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার সহযোগী ছিল। জামাতের এ যুদ্ধাপরাধের কোনো প্রকৃত বিচার এ শাসকশ্রেণি ও রাষ্ট্রযন্ত্র করেনি। হাসিনা-আওয়ামী ফ্যাসিবাদীরা গণআন্দোলনের চাপে ও ভোটের মাঠের হিসেব কষে বিগত আমলে কিছু জামাত নেতাকে ’৭১-এর অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল। একইসাথে শেষ সময়ে জামাতকে নিষিদ্ধও করেছিল। এটা ছিল তার টিকে থাকার অপকৌশল। হাসিনার অপকৌশল যা-ই থাকুক না কেন, ’৭১-সালের ক্ষমা-অযোগ্য অপরাধের জন্য তাদের সার্বিক বিচার ও জামাত-রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি একটি গণতান্ত্রিক দাবি ছিল ও রয়েছে। কিন্তু হাসিনা-ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের ফাঁক গলে জামাত এখন জাতীয় রাজনীতিতে এতটা প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে যে, তারা এখন ক্ষমতায় যাবার স্বপ্নও দেখছে। এ সুযোগ তাদেরকে করে দিয়েছে বিগত কয়েক দশক ধরে হাসিনা-আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ প্রতিটি বুর্জোয়া পার্টি, বিশেষত বর্তমান ইউনূস সরকার। এ সরকার জামাতের বিরুদ্ধে সকল সঠিক মামলাগুলোও তুলে নিচ্ছে। জামাত এখন তাদের মৃতুদণ্ড প্রাপ্ত নেতাদেরকে শহিদ বলে দাবি করছে। এ অবস্থায় ‘যদি’ তারা ভুল করে থাকে বলার মাধ্যমে, এবং ’৪৭ থেকে এ পর্যন্ত দীর্ঘ ৭৭ বছর টেনে এনে ’৭১-কে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা নির্বাচনি অপকৌশল ও ফ্যাসিবাদী রাজনীতির ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়। কিছুদিন আগেও তাদের নেতারা বলেছে ’৭১-সালে বর্তমান নেতাদের জন্ম হয়নি বা তারা বালক ছিল; তাই তারা অপরাধী নয়। তাহলে কি ব্রিটিশ আমলের অপরাধের জন্য বর্তমান ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে আমরা দায়ী করবো না? বুর্জোয়া রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ জনমত তৈরি করছিল যে, তাদেরকে ক্ষমা চাইতে হবে। এখন যদি হাসিনা বা তার নেতারা বিগত হত্যাকাণ্ডের জন্য ক্ষমা চায় তাহলে কি তাদের রাজনীতি বৈধ হয়ে যাবে?

তাই, বুর্জোয়া রাজনীতির প্রতারণা ও সকল গোষ্ঠীর ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে উন্মোচন ও লড়াই অব্যাহত রাখতে হবে। 

–২৫-১০-’২৫

আরও খবর
 
শনি
রোব
সোম
মঙ্গল
বুধ
বৃহ
শুক্র